জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতায় হেরে যান তাহের- মোহাম্মদ শাহজাহান

0 817
 ৭ নভেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কিত দিন। অথচ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি এই কালো দিনটিকে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। বিএনপি বলছে, ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের ফলে জিয়াউর রহমান ছাত্র-জনতা-সৈনিকের কাছে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। জাসদ বলছে, কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহিরা ওইদিন জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে নতুন জীবন দিয়েছিল। বিনিময়ে তাহেরকে হত্যা করে জিয়া ইতিহাসে মীরজাফরের পাশে স্থান করে নিয়েছেন। জাসদ ৭ নভেম্বরকে সিপাহি বিপ্লব দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। আর মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, ঐদিন ঠাণ্ডা মাথায় মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে সাহসী ও সুদক্ষ সমরনায়ক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম, বীর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল এটিএম হায়দার বীরউত্তম ও সাব-সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নজমুল হুদা বীরবিক্রমকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। আসলে ৭ নভেম্বর, ৩ নভেম্বর ও ১৫ আগস্ট ওই তিনটি দিনেই আমাদের জাতির ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় কলঙ্ক রচিত হয়েছে। ৭ নভেম্বর, ৩ নভেম্বর ও ১৫ আগস্ট কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত চার দশকেও আমরা ওই কলঙ্কের বেড়াজাল থেকে বের হতে পারিনি। যে স্বাধীনতাবিরোধী দেশি ও আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করার জন্য পরিবারের সদস্যসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ১৫ আগস্ট হত্যা করেছে, ওই চক্রই ৮০ দিনের মাথায় ৩ নভেম্বর ভোরে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার নেতাকে হত্যা করেছে। ২ নভেম্বর ১৯৭৫, দিবাগত রাতে খালেদ, শাফায়াত ও নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে ক্যু এর কার্যক্রম শুরু হলে বঙ্গভবনে অবস্থানকারী বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্র পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক চার নেতাকে হত্যা করে। খালেদ-শাফায়াতদের খামখেয়ালি, অদূরদর্শিতা ও নির্বুদ্ধিতার কারণে ৩ নভেম্বরের সফল অভ্যুত্থান চার দিনের মাথায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং এর মাশুল হিসেবে খালেদসহ মুক্তিযুদ্ধের তিন বীর সেনানি অসহায়ের মতো জীবন দান করেন।
হত্যাকারী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা কৌশলগত কারণেই তাদের পছন্দের মানুষ জিয়াকে ক্ষমতায় না বসিয়ে ‘ডামি’ হিসেবে খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতির গদিতে বসায়। মুজিব হত্যার ৯ দিন পর সেনাপ্রধান কেএম সফিউল্লাহকে উপ-সেনাপ্রধান, জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান এবং ৬ মাসের মাথায় পর পর দুটি পদোন্নতি দিয়ে এরশাদকে উপ-সেনাপ্রধান নিযুক্ত করা হয়। সেনাবাহিনীতে জিয়ার পরেই ছিল সিজিএস খালেদ মোশাররফের অবস্থান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী চক্রের মূল লক্ষ্যই ছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়া। খুনি সর্দার ফারুক-রশীদরা জিয়াকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করলেও বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা এরশাদকে উপ-প্রধান বানায়। মুক্তিযুদ্ধ থেকেই জিয়া-খালেদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না। আবার অবৈধ রাষ্ট্রপতি মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী জিয়াকে পছন্দ করতেন না। জনক হত্যার পর খুনি মেজর চক্র বঙ্গভবনেই অবস্থান করতে থাকে। মূলত তখন তারাই ছিল সর্বেসর্বা। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড প্রায় ভেঙে পড়ে। সিনিয়র সেনা কর্মকর্তারা চেইন অব কমান্ড পুনরুদ্ধারের জন্য সেনাপ্রধান জিয়ার দ্বারস্থ হলেও কোনো কাজ হয়নি। খুনি মেজররা জিয়াকে সেনাপ্রধান বানিয়েছে। জিয়া তাদের ক্ষেপাতে অনাগ্রহী ছিলেন। সেনাপ্রধান উভয় পক্ষের সঙ্গে এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করে চলছিলেন। খালেদের মধ্যে ভীতি ছিল, খুনিচক্র তাকে সরিয়ে দিতে পারে।
এমন জটিল পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে এনে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতেই খালেদ-শাফায়েতরা ২ নভেম্বর ’৭৫ মধ্যরাতে অভ্যুত্থান শুরু করে। জিয়াকে গৃহবন্দি করা হলেও মূলত তিনি বন্দি ছিলেন না। শোবার ঘরের টেলিফোন দিয়ে বেগম জিয়া ওসমানী, কর্নেল মইনুলসহ আরও অনেকের সঙ্গে এবং জিয়া কর্নেল তাহেরসহ অন্যদের সঙ্গে কথা বলেন। জিয়া তাকে উদ্ধারের জন্য তাহেরকে সকাতর অনুনয়-বিনয় করেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের সেনাবাহিনী থেকে বের হয়ে এসে বহুদিন ধরেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য গোপনে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাহের ভাবলেন, সেনাপ্রধান জিয়াকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের এটাই সুবর্ণ সুযোগ। জেলে চার নেতা হত্যার খবর খালেদরা ৪ নভেম্বর মঙ্গলবার বেলা ১০টা পর্যন্ত জানতেন না। হত্যার প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর অভ্যুত্থানকারীরা ৪ নেতা হত্যার খবর জানতে পারেন। এর মধ্যেই খুনিরা দেশের বাইরে চলে গেছে।
এদিকে খালেদের অভ্যুত্থান শুরুর পর থেকেই জিয়ার পক্ষের সেনা কর্মচারী-কর্মকর্তারা এ অভ্যুত্থানকে ভারতপন্থি হিসেবে অপপ্রচার করতে থাকে। একই সঙ্গে কর্নেল তাহেরগং খালেদকে ভারতের চর বলে অপপ্রচার চালিয়ে ক্ষমতা দখলের পথে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। পাকিস্তানের দালাল বিবিসির সাংবাদিক আতিকুল আলম প্রচার চালায় যে, ভারত সরকার খালেদের অভ্যুত্থানকে মদদ দিচ্ছে। আতিকুল আলম নাকি ভারত সরকারের খালেদকে দেয়া সমর্থনসূচক জাল চিঠিও কাউকে কাউকে দেখায়। সেনানিবাসগুলোতে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে লিফলেট ছেড়ে জিয়া-তাহের চক্রের পক্ষের লোকজন এমন অপপ্রচার চালায় যে, ভারতের সমর্থন নিয়ে খালেদ-শাফায়েতরা আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় বসাতে চাচ্ছে।
আরেকটি ঘটনা অপপ্রচারকারীদের সুবিধা করে দেয়। ৪ নভেম্বর ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের ডিফেন্স এটাচি ব্রিগেডিয়ার ডোরা আকস্মিকভাবে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করতে সেনানিবাসে আসেন। সাক্ষাৎকারের পূর্ব অনুমতি ছিল না। ফলে দূতাবাস কর্মকর্তাকে ফিরে যেতে হলো দেখা না করে। খালেদের জন্য শুভেচ্ছাস্বরূপ ভারতীয় কর্মকর্তা একটি প্যাকেট রেখে যান। খালেদ সেই প্যাকেট দেখার কোনো সময় পাননি। ডোরার আগমন এবং এ সংকটময় মুহূর্তে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করার কারণ কেউই জানতে পারলো না। কিন্তু সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে এ ঘটনা খালেদ মোশাররফের প্রো-ইন্ডিয়ান হওয়ার গুজবে আরো ইন্ধন জোগায়। পরে জানা যায়, ওই প্যাকেটে একপ্রস্থ কাপড় ছিল। এই কাপড়ের জন্য খালেদ আগে কোনো এক সময় দূতাবাসের কাউকে অনুরোধ করেছিলেন। তাহের ও জিয়ার সমর্থকরা ছাড়াও পরিকল্পিতভাবে জোরালোভাবে এটা বলা হয় যে, ভারতের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা রয়েছে খালেদের ক্যু এর সঙ্গে। কিন্তু শতভাগ নির্জলা সত্য হচ্ছে, খালেদের ক্যু-এর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ভারতের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না। খালেদরা এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের বা ভারতের কোন মহলের সঙ্গে কোন কথাই বলেননি। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগই যদি থাকতো, তাহলে তো ক্যু এর শুরুতেই জেলে আটক চার জাতীয় নেতাকে বের করে আনা হতো। তাছাড়া মোশতাক ও খালেদের উৎখাতের খবরে আওয়ামী লীগার, ছাত্র এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত দলগুলো রাস্তায় নেমে আসে। ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর স্মরণে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত মৌন মিছিলে খালেদ মোশাররফের ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ এবং খালেদের মা যোগ দেয়ায় শত্রুরা জোরেশোরে অপপ্রচার করতে থাকে। অন্যদিকে খালেদের ৪ দিনের ক্যু এর সময় তাদের পক্ষ থেকে কোন বক্তব্যই দেয়া হয়নি।
খালেদ ৫ নভেম্বর বুধবার পত্রিকায় মা ও ভাইয়ের ছবি দেখে ঘাবড়ে যায়। টেলিফোন তুলে সঙ্গে সঙ্গে তার মাকে জিজ্ঞেস করেন- “এটা তোমরা কি করেছো? তোমরা মিছিলে গেছো আর পত্রিকায় তোমাদের ছবি ছাপা হয়েছে। এটা করে তোমরা আমার দিন ফুরিয়ে দিয়েছো। আমি আর নাও বাঁচতে পারি। ” বার বার অনুরোধেও খালেদ বেতার বা টিভিতে যাননি। ইচ্ছে করলে রাষ্ট্রপতি হতে পারতেন, তাও হননি। মোশতাক এবং জিয়াকে হত্যা করতে পারতেন, খালেদ সেটাও করেননি। আর্মির শৃঙ্খলার স্বার্থে জিয়াকে সরিয়ে খালেদ সেনাপ্রধান হন। কারণ, জিয়া আর্মির চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে কোন কিছু করেননি। জেলে হত্যার পর মোশতাককে সরিয়ে প্রধান বিচারপতি এএম সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়।
তাহের ও জিয়ারা যে খালেদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করছে, সেই খোঁজখবরও খালেদ ও তার সহকর্মী সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল না। খালেদ ক্যু এর নেতৃত্বে থাকলেও এটাকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে কোনো চেষ্টাই করেননি। এমনকি ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত এই ৪ দিন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও কাজে লাগাননি। ফলে যা হবার তাই হলো। এভাবে ব্রিগেডিয়ার খালেদ, ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ও কর্নেল শাফায়াত জামিলদের উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে ৬ নভেম্বর রাতেই তাহের ক্ষমতা দখলের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
আসলে ৩ নভেম্বর থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত দেশে কোনো সরকার ছিল না। খালেদ কেন ক্যু করলেন, এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি এ সম্পর্কে তিনি নিজে বা তার পক্ষ থেকে কেউ জনগণকে কিছু বলেনি। জনগণকে জানাতে বলা হলে খালেদের উত্তর ছিল- ‘আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি কেন রেডিও বা টিভিতে বক্তৃতা করতে যাব।’ আর্মি সদর দফতরেও অচলাবস্থা বিরাজ করছিল। সেনা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখানে-সেখানে জটলা পাকিয়ে আলাপ-আলোচনা করে সময় কাটায়। ওই সময় সেনানিবাসে একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে ছাপানো প্রচারপত্রে উত্তেজক ভাষায় বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল সেনাবাহিনীতে কোনো অফিসার থাকবে না। কারণ হিসেবে বলা হয়, অফিসারগণ ক্ষমতা করায়ত্তের জন্য সৈনিকদের ব্যবহার করে। তাছাড়া অফিসারদের জন্য ‘ব্যাটমেন’ প্রথা বন্ধ করার কথা বলা হয়। ওই সময় ক্যান্টনমেন্টে সৈনিকদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। তারা অফিসারদের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলতে থাকে। খালেদের ক্যুর অন্যতম সিপাহসালার কর্নেল সাফায়াত জামিল তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘৬ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে খালেদ মোশাররফ ফোন করে তাকে বঙ্গভবনে যেতে বললেন। বঙ্গভবনে যাওয়ার জন্য তিনি গাড়িতে উঠছেন এমন সময় ব্রিগেড মেজর হাফিজ তাকে বলল, ‘স্যার একটা জরুরি কথা আছে।’ হাফিজ জানান, প্রথম বেঙ্গলের একজন প্রবীণ জেসিও বলেছে, ‘ঐদিন রাত ১২টায় সিপাইরা বিদ্রোহ করবে। জাসদ ও সৈনিক সংস্থার আহ্বানেই তারা এটা করছে। খালেদ এবং শাফায়াতকে হত্যারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বঙ্গভবনে তিন বাহিনী প্রধানের সভায় শাফায়াত জামিল, রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল হুদা ও চট্টগ্রামের একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে. কর্নেল হায়দারও উপস্থিত ছিলেন। রাত ১২টার দিকে ‘নারায়ে তাকবির, সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই- অফিসারদের রক্ত চাই’ এবং ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই- সুবেদারদের ওপর অফিসার নাই’ স্লোগান দিতে দিতে সিপাহিরা বের হয়ে পড়ে। সিপাহিরা অস্ত্রাগার লুট করে। সেনানিবাসের সেনা কর্মকর্তারা অসহায়ের মতো এদিক-সেদিক পালাতে থাকে। বিশৃঙ্খল সিপাহিরা কর্নেল ওসমানের মুক্তিযোদ্ধা স্ত্রী নাজিয়া ওসমান, একজন লেডি ডাক্তারসহ ১৩ জন নিরপরাধ সেনা সদস্যকে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন- মেজর আজিম, ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন, লে. মুস্তাফিজুর রহমান, ডেন্টাল সার্জন করিম এবং আর্মির লেডি ডাক্তার চেরী। অরক্ষিত সেনা কর্মকর্তাদের স্ত্রী-কন্যাদের লাঞ্ছিত করার মতো দুঃখজনক ঘটনাও ওই রাতে ঘটে। টেলিভিশন ভবনে দায়িত্বরত ৪ কর্মকর্তাকেও খুনি চক্র হত্যা করে ওই রাতে।
সিপাহিরা মধ্যরাতেই জিয়াকে মুক্ত করে। রাতেই রেডিওতে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে জেনারেল জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। ওই সময় তাহেরকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে জিয়া কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। তখন ১৫ আগস্টের খুনিচক্রসহ সবাই জিয়ার চারপাশে ভিড় জমায়। মুহূর্তে জেনারেল জিয়া সর্বময় ক্ষমতার মালিক হয়ে গেলেন। ৬ নভেম্বর রাত ১২টায় বিদ্রোহের কথা শুনে কর্নেল হায়দার ও কর্নেল নজমুল হুদাকে নিয়ে খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবন ত্যাগ করে রংপুর থেকে আসা শেরেবাংলা নগরে বিশ্রামরত ১০ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে আশ্রয় নেন। ’৭১ সালে খালেদই এই ব্যাটালিয়নটি সৃষ্টি করেন। যদ্দুর জানা যায়, ৭ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে মেজর জলিল ও মেজর আসাদ নামের দুই সেনা কর্মকর্তা খালেদ, হায়দার ও হুদাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে। জেনারেল জিয়া মধ্যরাত থেকেই সর্মময় ক্ষমতার মালিক। এই তিন বীর সেনানি হত্যার দায়ভার জিয়ার ওপরই বর্তায়। কার প্ররোচনায় বা নির্দেশে এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হলো, জাতি বিগত ৪৪ বছরে তা জানতে পারেনি।
শেষ পর্যন্ত জিয়ার বেঈমানির কাছে তাহের হেরে যান। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত কর্নেল তাহেরকে ১৭ দিন পর অর্থাৎ ২৪ নভেম্বর ’৭৫ গ্রেফতার করেন জেনারেল জিয়া। গোপন বিচারে দণ্ডিত কর্নেল তাহেরকে ১৯৭৬-এর ২১ জুলাই ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে দেয়া হয়। তবে ফাঁসির পূর্বমুহূর্তে কর্নেল তাহের যে সাহস, বীরত্ব, দৃঢ়তা ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে গেছেন, ইতিহাসে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ট্রাইব্যুনালে গোপন বিচার চলাকালে জবানবন্দীর এক পর্যায়ে তাহের বলেন, ‘আমাদের জাতির ইতিহাসে আর একটাই মাত্র বিশ্বাসঘাতকতার নজির রয়েছে, তা হচ্ছে মীরজাফরের। বাঙালি জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে গোটা উপমহাদেশকে ২শ’ বছরের গোলামীর পথে ঠেলে দিয়েছিল। ভাগ্য ভালো যে এটা ১৭৫৭ সাল নয়। ১১৭৬। আমাদের আছে বিপ্লবী সিপাহি জনতা, তারা জিয়াউর রহমানের মতো বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তকে নির্মূল করবে।’ (লিফসুজের ইংরেজিতে লেখা বইয়ের বঙ্গানুবাদ ‘অসমাপ্ত বিপ্লব- তাহেরের শেষ কথা’, পৃষ্ঠা-১৪৩)। বিচারককে উদ্দেশ্য করে তাহের আরো বলেন, “আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি বৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সরকারকে উৎখাত করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছি। কিন্তু মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করেছিল কারা? কারা সেই সরকারকে উৎখাত করেছিল? মুজিবের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কে ক্ষমতায় এসেছিল? এখানে অভিযুক্তদের কেউ কি এসব ঘটিয়েছিল? নাকি এখানে উপবিষ্ট আপনারা এবং তারা- যাদের আজ্ঞা আপনি পালন করে যাচ্ছেন, তারাই কি মুজিব হত্যার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বেশি লাভবান হননি?” (ওই গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-১৪৫)।
রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে জেনারেল জিয়া ৭ নভেম্বরকে ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন এবং ঐদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। জিয়ার পর এরশাদ ও বেগম জিয়া এই ধারা অব্যাহত রাখেন। আসলে ওইদিন সন্ত্রাসী সিপাহিরা চেইন অব কমান্ড ভেঙে অস্ত্রাগার লুট করে নারীসহ নিরপরাধ সেনা অফিসারদের হত্যা করে। ৭ নভেম্বর দিনের বেলা মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি সেনানায়ক খালেদ মোশাররফসহ আরও দুই বীরকে ঠাণ্ডা মাথায় সেনা হেফাজতে হত্যা করা হয়। তাহেরের কথিত বিপ্লবের মাধ্যমেই তো জিয়া মুক্ত হন এবং সর্বময় ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ৭ নভেম্বর যদি বিপ্লব হয়ে থাকে তাহলে কথিত বিপ্লবের সর্দার তাহেরকে হত্যা করলেন জেনারেল জিয়া। কর্নেল শাফায়াত জামিল তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড তদন্ত ও বিচারের হাত থেকে চিরদিনের জন্য দায়মুক্ত থাকার ব্যবস্থা হিসেবেই জেনারেল জিয়া ওই দিনকে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি ঘোষণা করেছিলেন। ’ হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের নায়ক কর্নেল তাহের। আর জিয়া খলনায়ক। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে জিয়া শুধু তাহেরকে নয়, কয়েক হাজার অফিসার ও সেনাকে হত্যা করেছিল।” দৈনিক সমকাল (৮.১১.২০০৭)। আসলে ওইদিন কোন বিপ্লব হয়নি। তাছাড়া জিয়া ছিলেন বন্দী। যারা জিয়াকে ওইদিনের ঘটনার নায়ক বা কথিত বিপ্লবের নেতা বলেন, তাদেরকে উন্মাদ ছাড়া আর কিইবা বলা যেতে পারে! কোন বন্দী কি আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে পারে? স্বাধীনতাবিরোধী চক্র, চাটুকার, সুশীল সমাজের কিছু দালাল যাই বলুন বা লিখুন না কেন, ইতিহাসে ৭ নভেম্বর কৃষ্ণদিবস, ঘৃণা দিবস, মুক্তিযোদ্ধা ও নারীসহ নিরপরাধ সেনা কর্মকর্তা হত্যা দিবস বা স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের পুনরুত্থান দিবস হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
৩ নভেম্বর ২০১৯
[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]
**লেখাটি দৈনিক সংবাদ এর ৫ নভেম্বরের সংখ্যা থেকে নেয়া।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.