আমি আমার পিতা শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম এবং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সম্পর্কে কিছু কথা বলব। প্রায় ৪১ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে স্মৃতিতে যা আছে তাই বলতে চাই।
সে সময়ে আমি ৮ বা ৯ বছরের শিশু ছিলাম। সেই দুঃসময়ের অনেক ঘটনা, অনেক স্মৃতি আজও স্মৃতিতে গেঁথে আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ দুর্দিনের কথা বা স্মৃতি কখনোই ভোলা যায় না। সেদিন বাবার কাছ থেকে যে সব কথা শুনেছি তা আজও স্মৃতিতে ঝলঝল করছে।
খালেদ মোশাররফ ও ৭ নভেম্বর সম্পর্কে কথা বলতে হলে একটু পিছনের ঘটনা অর্থাৎ ১৫ আগস্টের ভয়াবহ নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করতে হবে। কারণ খালেদ মোশাররফকে হত্যা ও ৭ নভেম্বরের ভয়াবহতার সঙ্গে ১৫ আগস্টের যোগসূত্র আছে। তাই আমি ১৫ আগস্ট থেকেই আমার স্মৃতিচারণ করতে চাই।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে বিশ্বাসঘাতক খুনি মোশতাক চক্র।
এদিন খুব ভোরে রেড ফোনে একটি ফোন কল আসে। আমরা সবাই তখন ঘুমিয়ে ছিলাম। ফোনটি ধরেন বাবা। শুনলাম সেনাবাহিনীর প্রধান কে.এম সফিউল্লাহ ফোন করেছেন। আরও জানলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি আর্মি আক্রমণ করেছে। তাই এখনই তাড়াতাড়ি বাবাকে সেনাপ্রধানের বাসায় যেতে হবে।
সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা স্তম্ভিত হয়ে পড়েন, পায়চারি করতে থাকেন এবং বলতে থাকেন সর্বনাশ হয়ে গেল, দেশের এখন কি হবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না, এটার প্রতিকার করতে হবে। এসব কথা বলতে বলতে রেডি হয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে সেনাপ্রধানের বাড়ি যান। সারাদিন বাবা আর বাসায় আসেননি। অনেক রাতে বাসায় আসেন। তারপর দেখলাম বাবাকে চিন্তিত-ব্যস্ততায়, বলা চলে ছটফট করছেন। তিনি শুধু বলতেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না, যে আমাদের একটা স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করে দিলেন তাঁর এ হত্যাকাণ্ড কখনো মেনে নেওয়া উচিত নয়। এর প্রতিকার করতে হবে। তা না হলে আমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে, আমাদের জাতি শেষ হয়ে যাবে। দেশ ও জাতিকে রক্ষার জন্য আমাদের খুবই তাড়াতাড়ি বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরদের প্রতিহত করতে হবে। এদের চরম শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কয়েকদিন পরই সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে.এম সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে উপপ্রধান জেনারেল জিয়াকে সেনা প্রধান করা হয়। তার কাছেও বাবা সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। কিন্তু জিয়া বাবার কথায় কর্ণপাত করেননি। তিনি খুনি মোশতাক ও মেজরদের পরামর্শ বা নির্দেশে চলতে থাকেন। এমনকি তিনি খুনি চক্রকে সাহায্য সহযোগিতা করেন। এটা বাবা মোটেই মেনে নিতে পারেননি। তাই বাবা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। এ সময় রক্ষীবাহিনীর প্রধান নূরুজ্জামান, ৪৬ ব্রিগেটের প্রধান শাফায়াত জামিল ও মেজর হাফিজ উদ্দিনসহ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরাও সবাই বাবার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন এবং তাড়াতাড়ি খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দেন। এদের সবাইকে আমাদের বাসায় এসে বাবার সঙ্গে সলাপরামর্শ করতে দেখিছি।
বাবা সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, বুদ্ধি-পরামর্শ করে নিজের নেতৃত্বে খুনিদের অপসারণ এবং সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৩ নভেম্বর ঘাতকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করেন। বাবার আলাপ-আলোচনা এবং আর্মির লোকজনদের আসা-যাওয়া ও তাদের কথাবার্তায় বুঝতে পারতাম কোনো কিছু করতে যাচ্ছেন সহকর্মীদের নিয়ে। তবে আমরা বুঝতাম না কি করতে যাচ্ছেন।
এদিকে ২ নভেম্বর মা-সহ আমাদের গুলশানে নানীর বাসায় পাঠিয়ে দেন। ৩ নভেম্বর ভোরে হেলিকপ্টার ও মিগ ফাইটার বিমানের বিকট শব্দে ঘুম ভাঙে। এ শব্দ শোনার পর লোকজনদের কাছে জানতে পারলাম, দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ক্ষমতা থেকে সরানো হচ্ছে। এ সময় আমাদের বাসায় লোকজনদের আনাগোনাও বৃদ্ধি পায়। তাদের সবাইকে দেখতাম খুবই হাসিখুশি ও উৎফুল্ল। এসব লোকদের কথাবার্তায় জানতে পারলাম, সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করা হয়েছে এবং বাবাকে মেজর জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয়েছে। পরদিন বেশ কয়েকটি পত্রিকায় বাবার ছবি দেখলাম বেজ পরিয়ে দিচ্ছেন নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রধান। আমরা তখন পদোন্নতি বা সেনাপ্রধান কি তা তেমন বুঝতাম না। কিন্তু বাসায় আসা আর্মির লোকজনদের খুবই উৎফুল্লতার সঙ্গে বলতে শুনি খালেদ মোশাররফের প্রমোশন হয়েছে। তাকে দেশের সেনাপ্রধান করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকেই শুনতাম এবার দেশ রক্ষা পেল, জাতি মুক্তি পেল। তারা আরও বলতেন— এবার মুজিব হত্যার বিচার হবে, এবার খুনিদের রক্ষা নাই।
এ সময় ভয়াবহ এক দুঃসংবাদ পাই। সংবাদটি ছিল জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার। এ সংবাদটি প্রচার হওয়ার পর সেনাবাহিনীর লোকজনদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এদিন বাসায় আসা লোকজনদেরও হায়মাতম করতে দেখেছি। এদিনেই আরও একটি খবর প্রচারিত হয়, বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে একটি শোক মিছিল যায়। মিছিলটির সামনে ছিলেন আমার দাদি জামিলা আক্তার ও আমার চাচা আওয়ামী লীগ নেতা রাসেদ মোশাররফ। এ সময় কেউ কেউ বলতে থাকে মিছিলটি খালেদ মোশাররফের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।
এদিকে প্রচার হতে থাকে নভেম্বরেই সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করছে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকজনরা। অবশ্য এ ধরনের সংস্থার নাম আগে কখনো শোনা যায়নি। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সংস্থাটি বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতা শুরু করেছে। শহরে তারা কিছু লিফলেট ছেড়েছে যাতে সাধারণ সৈনিকদের উস্কানি দেওয়া হয়েছে। আরও গুজব শোনা যাচ্ছিল বাবা এবং শাফায়াত জামিলকে হত্যা করতেও পারে।
এ সময় আমরা মার সঙ্গে আমি নানীর বাসায় ছিলাম। কয়েকদিন যাবৎ আমরা তিন বোন ও মার সঙ্গে বাবার দেখা সাক্ষাৎ এবং কোনো কথাবার্তা হয়নি। যার জন্য ৬ নভেম্বর সকালে মা ক্যান্টনমেন্টের বাসায় যান। রাত ৭টার সময় বাবা বাসায় আসেন। তখন বাসায় বহুলোক বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য আসেন। ওই সময় বাবাকে খুব হাসি-খুশি ও উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। গত কয়েকদিনের অনেক ঘটনাই বাবার কাছ থেকে মা শুনলেন এবং রাতে একত্রে খাবার খান। এটাই ছিল বাবার সঙ্গে ‘মায়ের’ জীবনের একত্রে শেষ খাওয়া। আলাপ-আলোচনার পর বাবা মাকে বললেন, খুবই ব্যস্ত আছি, এখনি বঙ্গভবনে যেতে হবে। একথা বলেই বাবা এক গাড়িতে এ.টি.এম হায়দারকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনের দিকে যান। আর মা আরেক গাড়িতে চড়ে গুলশানে নানীর বাসার দিকে রওনা দেন। এটাই বাবার সঙ্গে মার শেষ দেখা।
বাবা যখন গাড়িতে উঠতে যান তখন আমার ছোট বোন তাইরিন মার কোলে। গাড়ির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাইরিন কেঁদে ওঠে। কান্নার শব্দ শোনে বাবা নেমে আসেন তার গাড়ি থেকে। তিনি তাইরিনকে কোলে নিলেন। বুকে জড়িয়ে আদর করল অনেকক্ষণ। মা সে কান্নার অর্থ খুঁজে পাননি। মা না জানলেও আমার অবুঝ শিশু বোন হয়তো জেনেছিল, বাবার পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে। আর সে রাতে বাবা বলেছিলেন তোমরা যাও— আমি আগামীকাল আসব। বাবা এসেছিলেন বাসায় তবে জীবিত অবস্থায় নয়, লাশ হয়ে।
মা বাসায় আসার কিছুক্ষণ পর আমরা সবাই ঘুমাতে যাই। রাতে ঘুমাচ্ছি, মধ্য রাতে ঘুম ভাঙে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে। শব্দ শোনা যাচ্ছিল ক্যান্টনমেন্টের দিকে। গোলা-গুলি শব্দেই বাসার সবাই জেগে উঠি। ভয় আর আতঙ্কে মা, নানা, নানী কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। আমার নানা-নানীর বেশ বয়স হয়েছে তখন। তারা ভয় আর আতঙ্কে কাঁপছিল। আমাদের তিন বোনের অবস্থাও একই। এ অবস্থায় আমার এক মামা বললেন- এ বাড়ি আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। কাজেই তাড়াতাড়ি এখান থেকে আমাদের সরে যেতে হবে, এখানে আমাদের থাকা উচিত হবে না। তার পরপরই আমরা মার খালার বাড়ি চলে যাই। সেখানে থেকেই মা বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেন। তখন বঙ্গভবনে মিটিং চলছিল, মা-বাবাকে বলেন- আমার মনে হয় অরাজক পরিস্থিতি শুরু হয়েছে। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আরও বলেন, আমরা এখন খালার বাড়ি আছি। একথা শোনার পর বাবা বললেন- তোমরা ওখানেই থাক, আমি এদিকে দেখছি। এটাই বাবার সঙ্গে মার শেষ কথা।
ঘুম ভাঙার পর আর ঘুমাতে পারিনি। ৭ তারিখ সকাল থেকেই মা-সহ বাসার সবাইকে চিন্তিত এবং অস্থির অবস্থায় দেখি। এ অবস্থা দেখে মাকে জিজ্ঞাসা করি- মা কি হয়েছে, মা শুধু বলত না কিছুই হয়নি। তোমরা আল্লাহেক ডাক, আল্লাহ কাছে প্রার্থনা কর, আল্লাহকে বল- তোমার বাবাকে যেন ভালো রাখে, আমাদের সবাইকে যেন ভালো রাখে। মার এ ধরনের কথা শোনার পর আমার মনে হলো- আমাদের কোনো বিপদ হচ্ছে। এদিকে সময় বাড়ার পর সকালের নাস্তার সময় হয়ে আসে কিন্তু বাসায় নাস্তার কোনো ব্যবস্থা দেখছি না। অবশ্য নাস্তা খাওয়ারও ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবে আমার দেড় বছরের ছোট শিশু বোন খাওয়ার জন্য কান্না শুরু করে। শিশু বোনের খাওয়ার দুধের বোতল, খাবার ও কাপড়-চোপড় আনতে আমার নানী তাদের বাসায় যান ৭ তারিখ সকাল ১০টার দিকে। উল্লেখ্য, মা-সহ আমরা সবাই রাতে যখন নানীর বাসা থেকে চলে আসি তখন কোনো কিছুই নিয়ে আনতে পারেননি মা। শুধু মাত্র পরনের কাপড়ে আমরা সবাই চলে আসি মার খালার বাসায়।
নানী তাদের বাসায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে কিছু আর্মি গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হয়। তারা গাড়ি থেকে নেমেই জিজ্ঞাসা করে খালেদ মোশাররফের স্ত্রী কোথায়। মাকে না পেয়ে আর্মি নানীকে ধরে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু নানী বহু কষ্ট ও চেষ্টা করে পাশের বাসায় গিয়ে জীবন রক্ষা করেন। আর্মিরা একদিকে মাকে খোঁজাখুঁজি করছে অন্যদিকে বাসার ভিতরে গিয়ে ভয়ঙ্কর ভাঙচুর লুটপাট শুরু করে। আলমারি ভেঙে মা ও নানীর গহনা গাটিসহ সব লুটপাট করে নিয়ে যায়। সেদিন যদি ঘাতকরা মা-সহ আমাদের পেত তাহলে আমরা হয়তো বাঁচতাম না। নানী যখন নিজের বাসা থেকে ফিরে খবর দেন, তখন মা-সহ সবার মাঝে চিন্তা আতঙ্ক আরও বাড়ে। মা তখন বার বার বলতে থাকেন— হে আল্লাহ এখন আমাদের কি হবে। হে আল্লাহ তুমি আমাদের রক্ষা কর। আমার স্বামীকে রক্ষা কর।
দুপুরের দিকে মার চাচা সংবাদ নিয়ে আসেন, তিনি জানালেন- খালেদ, হুদা ও হায়দারকে হত্যা করা হয়েছে। হঠাৎ বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনে মার অবস্থা কি হতে পারে সবাই বোঝেন। এটা মা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেননি। মা তখন বলতে থাকেন, হায় আল্লাহ কি হলো, তাঁকে কেন এভাবে হত্যা করা হলো। মার চিৎকার শুনে আমি যখন বুঝলাম, তখন আমারও অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। পিতার মৃত্যুর সংবাদ শুনে শিশু মনের যে ভয়ানক অবস্থা হয় আমারও তাই হয়। আমিও চিৎকার করতে থাকি। তখন আমাদের সান্ত্বনা দেওয়ারও কোনো মানুষ ছিল না। কারণ আমাদের কাছে কোনো মানুষ আসতে সাহস পেত না। আসলে যদি আর্মি খুন করে, এ ভয়ে। সব কিছু তখন অন্ধকার লাগছিল।
৪ দিন পর বাবার লাশ আনা হলো। তা দেখার পর আরও অন্ধকার লাগছিল। তখন মুখে কোনো ভাষাই ছিল না মার। আমি বাবার লাশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাগলের মতো অঝোরে চিৎকার করেছি। বাবাকে গোসল করানো হয়। বাবাকে যখন কবর দিতে নিয়ে যায়, তখন আমার ছোট বোন বলত মা, বাবাকে কোথায় নিয়ে যায়। বাবাকে ওভাবে নিয়ে যাচ্ছে কেন? ওর কথায় সবার মুখ কালো হয়ে যায়, চোখে পানি এসে যায়। কিন্তু ওর কথার কোনো জবাব ছিল না মার মুখে। ছোট বোনটি মৃত্যু কি তা বুঝত না। যার জন্য বাবাকে কবর দিয়ে আসার পর বা অনেক দিন পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করত মা- বাবা কোথায় আছে, বাবা কোন দিন আসবে। এ ধরনের কথার কোনো উত্তর ছিল না মার মুখে।
বাবার এ নির্মম মৃত্যুর পর মা আমাদের তিন বোনকে নিয়ে খুবই অসহায় হয়ে পড়েন। আমাদের নিয়ে মা খড়কুটার মতো এখানে সেখানে প্রাণ ভয়ে ভেসে বেড়িয়েছেন। কোথাও আমাদের থাকার একটু জায়গা ছিল না। কীভাবে সেদিন আমাদের দিন কেটেছে তা ভাবলে আজও ভয়ে আমার শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে।
মৃত্যুর সময় বাবা কিছু্ই রেখে যাননি, বরং ১৪ হাজার টাকা ঋণ ছিল। যা বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে। গুলশানে মার নামে এলটমেন্ট ছিল, তা নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকার ষড়যন্ত্র করে। এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। শুধু পেনশনের সামান্য টাকা এবং আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্য সহযোগিতায় আমাদের তিন বোন নিয়ে মা বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছেন।
আমার পিতা শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ নেই। তাকে আর কোনো দিন আমরা পাব না। সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিলেও আমরা তিন বোন পিতৃস্নেহ পাব না। কিন্তু আমরা পিতা হত্যার বিচার থেকে বঞ্চিত হবো এটা মেনে নিতে পারছি না। প্রায় ৪১ বছর ধরে পিতৃহত্যার বিচারের অপেক্ষায় আছি। এত দিন আমরা বিচারের দাবিও করতে পারিনি। কারণ হত্যাকারীরাই বা তাদের সহযোগীরাই অধিকাংশ সময় দেশের শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। তাদের নিপীড়ন-নির্যাতনে আমাদের জীবন যায় যায় অবস্থা। তবে আজকে দীর্ঘদিন পরে হলেও সুযোগ আসছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার কারণে। কাজেই আজকে আমি জোর দাবি জানাব ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের বিচারের। সেদিন হত্যা করা হয় ২নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কে. ফোর্সের অধিনায়ক প্রখ্যাত সমর বিশারদ, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুজিব হত্যার প্রতিবাদকারী, সেনাপ্রধান শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল নাজমুল হুদা বীর বিক্রম, ২নং সেক্টরের কমান্ডার লেফটেনেন্ট কর্নেল এ.টি.এম হায়দার বীর উত্তমসহ অসংখ্য সেনা কর্মকর্তা ও জোয়ানদের। ৮ নভেম্বর হত্যা করা হয় ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন, লে. মুস্তাফিজুর রহমান, মেজর আজিম, ডেন্টাল সার্জন করিম এবং আর্মির লেডি ডাক্তার চেরীকে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ৭ নভেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা ও সৈনিক হত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক। একই সঙ্গে দাবি জানাব সেদিনের হত্যাকাণ্ডের সব বিতর্কের অবসানের জন্য তদন্ত করে সঠিক ঘটনা জাতিকে জানানো হোক। বিশেষ করে— খালেদ মোশাররফকে ভারতীয় দালাল হিসেবে অপপ্রচার চালিয়ে সেনাবাহিনী ও জাতিকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। আজও অনেকেই এই অপপ্রচার চালিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে। যদিও প্রমাণ হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়েছে। তার পরও এটা সরকারিভাবে তদন্ত করে যেসব যড়ষন্ত্রকারীরা অপপ্রচার চালিয়েছে, তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
আমি আরও দাবি করব সেনাবাহিনীর সদর দফতরের আর্মি অ্যাওয়ার্ড বোর্ডের সেনাপ্রধানের তালিকায় সেনাপ্রধান হিসেবে শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নাম যুক্ত করার। গত ৪১ বছর তার নাম কেন তালিকাভুক্ত করা হয়নি এটাও আমরা জানতে চাই। এ দাবি শুধু খালেদ মোশাররফের কন্যা হিসেবে আমার একার নয়। এ দাবি ২নং সেক্টর এবং কে. ফোর্সের সব মুক্তিযোদ্ধার। এ দাবি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশের প্রতিটি নাগরিকের।
আমি আশা করি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও হত্যার রাজনীতি বন্ধের লক্ষ্যে আমার উত্থাপিত দাবি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তিনি ইতিমধ্যে ১৫ আগস্ট হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় এনে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা এবং জেল হত্যা বিচার কার্যক্রম শুরু করে শুধু দেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি ৭ নভেম্বরের খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা করে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালক হিসেবে দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে নিজের সুনামকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করবেন।
লেখক : সংসদ সদস্য, শহীদ খালেদ মোশাররফের কন্যা।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.