দাউদকান্দির কৃতি সন্তান, আমার প্রিয় শিক্ষক মরহুম অধ্যক্ষ এফ.এম. আবদুর রব স্যারের (আমার সাফল্যের পথপ্রদর্শক) আজ “প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ভালো শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের হৃদয়ের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকেন। শিক্ষকের জ্ঞান, দর্শন, শিক্ষা ও জীবনবোধ তাঁর অজান্তে শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রোথিত হয়। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে কোনো কোনো শিক্ষার্থী তাঁর প্রিয় শিক্ষকের স্মৃতিচারণা করেন। মরহুম এফ.এম. আবদুর রব স্যার, আমার জীবনকে নাড়া দিয়েছেন বিরাট করে, আমি এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বুননে প্রভাবিত করেছে প্রবলভাবে। তাঁর অনুপ্রেরণা ও আদর্শ ধারণকারী অনেক ছাত্র আজ বিখ্যাত, সেনাবাহিনী প্রধান থেকে শুরু করে অনেকেই দেশসেবায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করছেন। তাই প্রিন্সিপাল আবদুর রব মানুষ তৈরির কারিগর।
ছবি: তৎকালীন,বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এডজুটেন্ট জেনারেল ব্রিগেডিয়ার আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম, বীর বিক্রম। (অবসর গ্রহণ করেন সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদবীতে) মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ পরিদর্শনের সময়তোলা ছবি।
শিক্ষকতা শুধু একটি বৃত্তি বা পেশা নয় বরং এটি একটি আরাধনা। আদর্শ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের জ্ঞান ও গুণে মুগ্ধ শিক্ষার্থী, শিক্ষককে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। স্যারের ঋণ, আমি জীবনেও শোধ করতে পারব না। তিনি ছিলেন দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর সুবল আফতাব স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র, দাউদকান্দি পাইলট হাইস্কুলের প্রাক্তন হেডমাস্টার এবং মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
মরহুম এফ.এম. আবদুর রব, ১৯৩৩ সালে কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার চরগোয়ালী গ্রামের প্রসিদ্ধ ফকির বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৫০ সালে মেধাতালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করে দাউদকান্দির গৌরীপুর সুবল আফতাব স্কুল হতে গণিত, আরবি ও ইতিহাসে লেটারমার্কসসহ মেট্রিকুলেশন পাশ করেন।
ছবি: দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত প্রিন্সিপাল আবদুর রব।
১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এ. এবং ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সসহ এম.এ. পাশ করেন। প্রথিতযশা লেখক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
এরপর ১৯৫৬ সালে ফেনী জেলার প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়- দাগনভূঁইয়ার “মিডল ইংলিশ স্কুলে (বর্তমানে আতাতুর্ক মডেল হাই স্কুল)” ইংরেজির শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৭ সালে “পূবাইল ভাদুন হাইস্কুলে”যোগদান করেন এবং একই সালের শেষের দিকে দর্শনার ঐতিহ্যবাহী “মেমনগর বিডি হাইস্কুলে”হেডমাস্টার হিসাবে যোগ দেন।
ছবি : প্রিন্সিপাল আবদুর রবের সঙ্গে লেখক।
উল্লেখ্য যে, ১৯৫৬ সালে, স্যারের ফুফাতো বোন জোছনা আরা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন প্রিন্সিপাল আবদুর রব। তিনি ১৯৬১ সালে দাউদকান্দি পাইলট হাইস্কুলে “হেড মাস্টার” পদে যোগদান করেন (বর্তমানে আমি এই স্কুলের গভর্নিংবডির সভাপতি)। ১৯৬৩ সালে প্রথম স্থান অধিকার করে ঢাকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.এড. ডিগ্রি লাভ করেন। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নে ১৯৬৪ সালে কলেজের প্রভাষক পদে যোগদান করেন।
১৯৭০-৭১ সালে ইউনিভার্সিটি অব নটিংহাম স্কুল অব এডুকেশন থেকে ডিপ্লোমা ইন-এডুকেশন অর্জন করেন। উনি যুক্তরাজ্যে থাকা অবস্থায় প্রবাসী বাঙালিদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে প্রচার-প্রচারণায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে আসেন।
মরহুম এফ.এম. আবদুর রব, ১৯৭৪ সালে ক্যাডেট কলেজ গভার্নিং বডির চেয়ারম্যান কর্তৃক “ক্যাডেট কলেজের সেরা শিক্ষক” হিসাবে “সার্টিফিকেট অব প্রফিসিয়েন্সি” এবং “স্বর্ণপদক” লাভ করেন। এবং একই বছর ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের “উপাধ্যক্ষ”হিসাবে যোগ দেন।
১৯৮১ সালে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে “অধ্যক্ষ” হিসেবে যোগদান করেন । স্যারের অবস্থানকালে, ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ “ঢাকা বোর্ডে” স্বরণকালের “ শ্রেষ্ঠ ফলাফল” অর্জন করে।
১৯৮৬ সালে বরিশাল ক্যাডেট কলেজে “অধ্যক্ষ” হিসাবে বদলী হন অধ্যক্ষ আবদুর রব। ১৯৮৭ সালে, সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পূর্বে বরিশাল ক্যাডেট কলেজই ছিল, স্যারের সর্বশেষ ক্যাডেট কলেজ।
অবসর গ্রহণের পরে, ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসাবে “ন্যাশনাল ব্যাংক পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ “ যোগদান এবং ২০০০ সালে “মিলেনিয়াম ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে”অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
এই প্রতিভাবান ভাষা সৈনিক- প্রিয় এই শিক্ষক জীবনে, যা অর্জন করেছেন, সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, দেশে-বিদেশে স্যারের অসংখ্য ছাত্রদের মাঝে। স্যারের লেখা “আপনার সন্তান ও ক্যাডেট কলেজ” এবং Self Teaching English Language দুটি উল্লেখযোগ্য বই ছাড়াও, বিভিন্নপত্র পত্রিকায় স্যারের অসংখ্য লেখা রয়েছে।
ছবি : প্রিন্সিপাল আবদুর রবের লেখা বই। বইটি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে আজও জনপ্রিয়।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ইং, শুক্রবার, বনানী সামরিক বাহিনী কবরস্থানে,পরিবারের সদস্য/ প্রাক্তন ছাত্র এবং শুভাকাঙ্খীদের উপস্থিতিতে, স্যারকে দাফন করা হয়। আজ “প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে”স্যারের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে সকলের কাছে দোয়া প্রার্থনা করছি। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক : উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, দাউদকান্দি, কুমিল্লা।